ডায়াবেটিস হলে রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা বা কার্যকারিতা কমে যায়। ইনসুলিনের কাজ হলো রক্তের গ্লুকোজ বা শর্করার বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা। ডায়াবেটিসের রোগীর সাধারণত রক্তে শর্করা বেড়ে যায়। এ জন্যই ডায়াবেটিসের রোগীদের শর্করা পরিমিত খেতে বলা হয়।
প্রথম কথা হলো, একটি সুষম খাদ্যাভ্যাসে শর্করার পরিমাণ দৈনিক চাহিদার ৪০-৫০ শতাংশ হওয়ার কথা। শর্করা শরীরের প্রধান জ্বালানি। দৈনন্দিন শক্তির উৎস। শর্করা একেবারে বাদ দিলে শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়ায় জ্বালানির উৎস হিসেবে গ্লুকোজের বদলে চর্বি ভাঙতে শুরু করে। এতে কিটোঅ্যাসিড তৈরি হতে থাকে, যা ক্ষতিকর। তাই জ্বালানির প্রধান উৎস বন্ধের দরকার নেই; বরং দেখতে হবে, কী ধরনের শর্করা খেলে রক্তে গ্লুকোজ বেশি বাড়বে না।
শর্করা মূলত দুই ধরনের। সহজ শর্করা ও জটিল শর্করা। জটিল শর্করায় কার্বন বন্ধন বেশি, ফাইবার বা আঁশ বেশি। তাই গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। মানে জটিল শর্করা ভেঙে গ্লুকোজ কম শোষিত হয়, রক্তে গ্লুকোজ বেশি বাড়ায় না। আবার সহজ শর্করা দ্রুত ভেঙে গ্লুকোজ অনেক বাড়িয়ে দেয়। তাই সহজ শর্করার বদলে জটিল শর্করা বেছে নিতে হবে। সাদা চিনি, সাদা চাল, সাদা ময়দার তৈরি খাবার, নুডলস, পাস্তা ইত্যাদি হলো সহজ শর্করা। আর লাল চাল, লাল আটা, গোটা শস্য যেমন ওটস, ব্রাউন নুডলস বা ব্রাউন পাস্তা ইত্যাদি জটিল শর্করা। ডায়াবেটিসের রোগীদের শর্করা খেলে এ ধরনের জটিল শর্করা খেতে হবে।
শাকসবজি ও ফলমূলেও কিন্তু চিনি বা শর্করা থাকে। তাহলে ডায়াবেটিসের রোগীরা কি এগুলো খাবেন না? মনে রাখবেন, আলু সবজির মধ্যে পড়ে না। আলুর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক বেশি, প্রায় ভাতের মতো। আলু খেলে গ্লুকোজ বেশি বাড়ে। মজার ব্যাপার হলো, মিষ্টি আলুতে আবার ফাইবার বেশি। ফলে এটি জটিল শর্করা এবং এতে অতটা গ্লুকোজ বাড়ে না।
অনেকের ধারণা, মাটির নিচের সবজিতে গ্লুকোজ বেশি। এই ধারণাও ভুল। যেমন গাজর, মুলা, বিট, কচুমুখী, শালগম ইত্যাদি মাটির নিচের সবজি হলেও এদের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম এবং ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য ভালো। বেশির ভাগ সবজির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স মাঝারি মানের। তাই খেতে কোনো বাধা নেই।
একই কথা প্রযোজ্য ফলমূলের ক্ষেত্রেও। কিছু ফলের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স একটু বেশি, যেমন খেজুর, তরমুজ, আম ইত্যাদি। আর বাকি বেশির ভাগ ফলের জিআই মাঝারি মাত্রার। ফলে শর্করা ছাড়াও থাকে নানা রকম ভিটামিন, খনিজ উপাদান ও ফাইবার। তাই ডায়াবেটিসের রোগীরা যেকোনো ফলই খেতে পারেন, তবে পরিমিত পরিমাণে।
আপনার যদি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে একটু একটু করে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন।
একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখাতে সাহায্য করবে। সাথে সাথে প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দিবে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো থাকতে সাহায্য করবে।
ডায়াবেটিস হলেই যে আপনাকে নির্দিষ্ট কিছু খাবার খাওয়া একেবারে ছেড়ে দিতে হবে—তা নয়। আপনি বিভিন্ন রকমের খাবার খেতে পারবেন, তবে কিছু খাবার অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে।
এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ—
- বৈচিত্রময় খাবার খাওয়া: প্রতিদিন একই ধরনের খাবার না খেয়ে, নানান রকমের ফলমূল, শাকসবজি ও কিছু শ্বেতসার-জাতীয় খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। যেমন: লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি ও আলু।
- এসব খাবার কমিয়ে দিন: চিনি, লবণ ও চর্বিজাতীয় খাবারের পরিমাণ একেবারেই কমিয়ে দেওয়া, অর্থাৎ যতটুকু না খেলেই নয় ঠিক ততটুকুই খাওয়া।
- সময়মত খাবার খান: প্রতিদিন সকালের নাশতা, দুপুরের ও রাতের খাবার সময়মত খেতে হবে। কোনো বেলার খাবার যেন বাদ না পড়ে।
আপনার যদি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে একটু একটু করে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন। এভাবে পরিবর্তন আনা আপনার জন্য সহজ হবে। একেবারে সম্পূর্ণ খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলার চেষ্টা না করাই ভালো।
একটি স্বাস্থ্যকর ও সুষম ডায়েটের জন্য পাচঁটি প্রধান গ্রুপ বা পদের খাবার খাওয়া প্রয়োজন। এসব হচ্ছে—
- ফলমূল ও শাকসবজি
- শ্বেতসার সমৃদ্ধ খাবার। যেমন: লাল বা বাদামী চালের ভাত, লাল আটার রুটি বা পাউরুটি
- প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। যেমন: ডিম, মাছ, মাংস, শিম ও অন্যান্য বীন, ডাল, বিভিন্ন ধরনের বাদাম
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার। যেমন: দই, ছানা ও পনির
- বিভিন্ন ধরনের তেল, মাখন, ঘি
আপনার দৈনিক কতটুকু খাবার ও পানীয় প্রয়োজন তা নির্ভর করে আপনার বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক পরিশ্রম এবং আপনি আপনার ওজন ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে কী ধরনের লক্ষ্য নির্ধারণ করছেন তার ওপর। সুষম খাদ্যাভ্যাসের অর্থ হল নির্দিষ্ট কিছু খাবার বেশি পরিমাণে এবং অন্যান্য খাবারগুলো কম পরিমাণে খাওয়া। আবার, কেবল এক ধরনের খাবার দেহের সব পুষ্টি উপাদানের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের মূল হল বৈচিত্র্য।
আমরা কখনোই বিশেষ ডায়াবেটিক আইক্রিম বা মিষ্টি খাওয়ার পরামর্শ দেই না। কোন খাবারকে “ডায়াবেটিক” খাবার বলা আসলে নীতিবিরুদ্ধ কারণ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ছাড়া এই ধরনের কোনো খাবারে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়—এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ডায়াবেটিসের এসব খাবার খাওয়া কমানোর উপায়
- সম্পূর্ণভাবে বাড়িতে রান্না করা খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। এতে আপনি কী পরিমাণে লবণ খাচ্ছেন তা সঠিকভাবে খেয়াল রাখতে পারবেন।
- চিনি ছাড়া চা-কফি খাওয়ার চেষ্টা করুন। এগুলো ফলের জুস বা স্মুদির থেকে ভালো, কারণ তাতে অতিরিক্ত শর্করা বা ক্যালরি থাকে না।
- খাবারের সাথে কাঁচা লবণ খাওয়া বন্ধ করে দিন – এর পরিবর্তে গোল মরিচের গুঁড়া এবং অন্যান্য মশলা ও হার্ব ব্যবহার করে স্বাদে নতুনত্ব আনা যেতে পারে।
- দোকানের সস ও মশলা মিক্স না কিনে বাড়িতেই বিভিন্ন সস ও ম্যারিনেট করার মশলা তৈরী করে খান।